আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস্ সালাম - ২য় পর্ব
আহমদ বদরুদ্দীন খান
(সম্পাদক : মাসিক মদীনা)
হযরত ইবরাহীম (আ.)—এর কাহিনী
হযরত নূহ্ (আ.)—এর আমলে সংঘটিত মহাপ্লাবনে কা’বাগৃহ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে
গিয়েছিল। আল্লাহ্ তা’আলা যখন এর পুনর্নির্মাণের ইচ্ছা করেন, তখন হযরত ইবরাহীম (আ.) কে এ কাজের জন্যে মনোনীত করেন এবং
তাঁকে স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে সিরিয়া থেকে হিজরত করে এই শুষ্ক
ও অনুর্বর মরু এলাকায় বসতি স্থাপনের আদেশ দেন।
Table of Contents
সহীহ্ বোখারীতে বর্ণিত আছে, ইসমাঈল তখন
দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিলেন। আদেশ অনুযায়ী হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁকে ও তাঁর জননী হাজেরাকে
বর্তমান কা’বা গৃহ ও যমযম কূপের অদূরে রেখে আসেন।
তখন এ স্থানটি পাহাড়-বেষ্টিত জনশূন্য প্রান্তর ছিল।
দূর-দূরান্ত
পর্যন্ত পানি ও জনবসতির কোন চিহ্ন ছিল। না।
হযরত ইবরাহীম (আ.) তাদের জন্যে একটি পাত্রে
কিছু খাদ্য এবং মশকে কিছু পানি রেখে দিলেন।
এরপর হযরত ইবরাহীম (আ.) সিরিয়া প্রত্যাবর্তনের
আদেশ পান। আর যে স্থানে আদেশটি লাভ করেন, সেখান থেকেই সিরিয়া রওয়ানা হয়ে যান।
আদেশ পালনে তিনি এতটুকু বিলম্বও সহ্য করেননি
যে, হাজেরাকে সংবাদ দিবেন এবং কিছু সান্ত্বনার বাক্য বলবেন।
হযরত হাজেরা যখন তাঁকে যেতে দেখলেন, তখন
ডেকে বললেন: আপনি আমাদেরকে কোথায় ছেড়ে যাচ্ছেন? এখানে না আছে কোন মানুষ, না আছে জীবন
ধারণের কোন উপকরণ।
কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ.) পিছনে ফিরেও
দেখলেন না। তখন হযরত হাজেরার মনে জাগল যে, আল্লাহ্ তা’আলার খলীল এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে
পারেন না। সম্ভবতঃ তিনি এই মর্মে আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ পেয়েছেন। তাই ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন: আল্লাহ্ কি আপনাকে এখান
থেকে চলে যাওয়ার আদেশ দিয়েছেন? হযরত ইবরাহীম (আ.) পিছনে তাকিয়ে উত্তর দিলেন: হ্যা।
হযরত হাজেরা একথা শুনে বললেন: (اِذًا لَا يُضَيِّعُنَا) “তবে কোন পরওয়া নেই। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই
আমাদেরকে বিনষ্ট হতে দিবেন না।”
হযরত ইবরাহীম (আ.) সম্মুখে অগ্রসর হতে
লাগলেন। যখন একটি পাহাড়ের পশ্চাতে পৌঁছলেন এবং হাজেরা ও ইসমাঈল দৃষ্টি থেকে অপসৃত
হয়ে গেল, তখন স্ত্রী ও পুত্রকে জনমানবহীন প্রান্তরে ছেড়ে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া
স্বরূপ আল্লাহ্ তা’আলার কাছে এই বলে দোয়া করলেন:
رَّبَّنَآ إِنِّيٓ أَسۡكَنتُ مِن ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيۡرِ ذِي زَرۡعٍ عِندَ بَيۡتِكَ ٱلۡمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ فَٱجۡعَلۡ أَفِۡٔدَةٗ مِّنَ ٱلنَّاسِ تَهۡوِيٓ إِلَيۡهِمۡ وَٱرۡزُقۡهُم مِّنَ ٱلثَّمَرَٰتِ لَعَلَّهُمۡ يَشۡكُرُونَ (سُورَةُ إِبۡرَاهِيمَ : ۳٧)
“হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার কতক বংশধরকে বসবাস করালাম ফসল—বিহীন উপত্যকায় আপনার পবিত্র গৃহের
সন্নিকটে।
হে আমাদের পালনকর্তা! এই জন্যে যে, তারা
যাতে নামায কায়েম করতে পারে। এখন আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দিন।
এবং ফল-ফলাদি দ্বারা তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করুন, যাতে তারা (আপনার এই অনুগ্রহের প্রতি) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।” (সূরা ইবরাহীম : ৩৭)
এই দোয়া করে হযরত ইবরাহীম (আ.) সিরিয়ায়
চলে গেলেন। এদিকে হযরত হাজেরা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে জনমানবহীন প্রান্তরে কালাতিপাত
করতে থাকেন।
এক সময় দারুণ পিপাসা তাঁকে পানির খোজে বের হতে বাধ্য করল। তিনি শিশুকে উন্মুক্ত প্রান্তরে রেখে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে বার
বার উঠানামা করতে লাগলেন।
কিন্তু কোথাও পানির চিহ্নমাত্র দেখলেন না এবং এমন কোন মানুষও দৃষ্টিগোচর হল না, যার কাছ থেকে পানি প্রাপ্তির তথ্য জানতে পারেন।
সাতবার ছুটাছুটি করার পর তিনি নিরাশ হয়ে
শিশুর কাছে ফিরে এলেন।
এ ঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যেই সাফা
ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে সাত বার দৌড়ানো কেয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যত বংশধরদের
জন্যে হজ্জের বিধি-বিধানে অত্যাবশ্যকীয় করা হয়েছে।
হযরত হাজেরা যখন শিশুর কাছে ফিরে এলেন,
তখন আল্লাহ্ তা’আলার রহমত নাযিল হল। হযরত জিবরাঈল (আ.) আগমন করলেন এবং শুষ্ক মরুভূমিতে
পানির একটি ধারা বইয়ে দিলেন।
বর্তমানে এই ধারার নাম যমযম। অতঃপর পানির
সন্ধান পেয়ে সেখানে প্রথমে জন্তু—জানোয়ার আগমন করল। জন্তু-জানোয়ার দেখে মানুষ এসে সেখানে আস্তানা গাড়ল। মক্কার জনপদের ভিত্তি
রচিত হয়ে গেল।
জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু আসবাবপত্রও
সংগৃহীত হয়ে গেল।
সদ্যোজাত শিশু ইসমাঈল লালিত-পালিত হয়ে কাজকর্মের উপযুক্ত হয়ে
গেলেন।
হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ্ তা’আলার ইঙ্গিতে মাঝে মাঝে এসে স্বীয়
স্ত্রী হাজেরা ও শিশু ইসমাঈলকে দেখে যেতেন।
এ সময় আল্লাহ্ বন্ধুর আরও একটি পরীক্ষা নিতে চাইলেন। বালক ইসমাঈল অসহায় ও দীনহীন অবস্থায় বড় হয়েছিলেন এবং পিতার স্নেহ-মমতা থেকেও বঞ্চিত ছিলেন।
এ সময় পিতা স্বহস্তে পুত্রকে জবাই করার
নির্দেশ পেলেন। কোরআনে বলা হয়েছে:
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡيَ قَالَ يَٰبُنَيَّ إِنِّيٓ أَرَىٰ فِي ٱلۡمَنَامِ أَنِّيٓ أَذۡبَحُكَ فَٱنظُرۡ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَٰٓأَبَتِ ٱفۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُۖ سَتَجِدُنِيٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّٰبِرِينَ (سُورَةُ الصَّافَّاتِ : ۱٠۲)
“বালক যখন পিতার কাজে কিছু সাহায্য করার যোগ্য হয়ে গেল, তখন ইবরাহীম তাকে বললেন : বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি।
এখন বল, তোমার কি অভিমত? পিতৃভক্ত বালক
বলল: হে আমার পিতা! আপনি যে আদেশ পেয়েছেন, তা পালন করুন। আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ্
এ ব্যাপারে ধৈর্যশীল পাবেন।” (সূরা সাফ্ফাত: ১০২)
হযরত ইব্রাহীম (আ) এর পুত্র কে জবাই করার নির্দেশ দিলেন:
হযরত খলীল (আ.) পুত্রকে জবাই করার জন্যে
মিনা প্রান্তরে নিয়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলার আদেশ পালনে নিজের পক্ষ থেকে যা করার ছিল, তা পুরোপুরিই নিবেদন করলেন।
কিন্তু এখানে পুত্রকে জবাই করানোই উদ্দেশ্য ছিল না; বরং পুত্রবৎসল পিতার পরীক্ষা নেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। পুত্র ইসমাঈল অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেন এবং তাঁর স্থলে জান্নাতের একটি দুম্বা কোরবানী হল।
কা’বা ঘর পূনরায় নির্মানের নির্দেশ:
এরপর হযরত ইসমাঈল (আ.) যখন যুবক ও বিবাহিত,
তখন একদিন হযরত ইবরাহীম (আ.) স্ত্রী ও পুত্রকে দেখার জন্যে মক্কা আগমন করলে ইসমাঈলকে
একটি গাছের নীচে বসে তীর বানাতে দেখতে পান।
পিতাকে দেখে পুত্র সসম্মানে দাঁড়িয়ে
গেলেন। দেখা-সাক্ষাতের পর হযরত ইবরাহীম (আ.) বললেন: আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন।
এতে তুমি আমাকে সাহায্য করবে? অতঃপর যে
টিলার নীচে কা’বাগৃহ অবস্থিত ছিল, হযরত ইবরাহীম (আ.) সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন:
আমি এর পুনর্নির্মাণের জন্যে আদিষ্ট হয়েছি।
আল্লাহ্ তা’আলা হযরত জিবরাঈল (আ.) মারফত হযরত
ইবরাহীম (আ.)-কে কা’বাগৃহের চতুঃসীমা বলে দিয়েছিলেন।
পিতাপুত্র উভয়ে মিলে কাজ আরম্ভ করলে কা’বাগৃহের প্রাচীন ভিত্তি বের হয়ে
পড়ল। অতঃপর এ ভিত্তির উপরই তাঁরা নির্মাণ কাজ আরম্ভ করলেন।
কোরআনে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে
:
وَإِذۡ يَرۡفَعُ إِبۡرَٰهِۧمُ ٱلۡقَوَاعِدَ مِنَ ٱلۡبَيۡتِ وَإِسۡمَٰعِيلُ (سُورَةُ البَقَرَةِ : ۱۲٧)
“স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল আল্লাহ্ তা’আলার গৃহের ভিত্তি উঁচু করছিল।” (সূরা বাকারাহ্ : ১২৭)
হযরত ইবরাহীম (আ.) ও নমরূদের অগ্নি:
মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও যুক্তিতর্কের
ক্ষেত্রে অপারগ হয়ে তখনকার জালেম শাসক নমরূদ ও তার সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত
নিল যে, ইবরাহীমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করতে হবে।
ঐতিহাসিক রেওয়ায়াতসমূহে বর্ণিত আছে যে,
একমাস পর্যন্ত সমগ্র শহরবাসী জ্বালানি কাষ্ঠ সংগ্রহ করতে থাকে।
এরপর তাতে অগ্নিসংযোগ করে সাতদিন পর্যন্ত
প্রজ্বলিত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আগুনের লেলিহান শিখা আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। তখন তারা
হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে এই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করার উদ্যোগ গ্রহণ করল।
কিন্তু অগ্নিকুণ্ডের নিকটে যাওয়াই সমস্যা
হয়ে দাঁড়াল। অগ্নির অসহ্য তাপের কারণে তার ধারে—কাছে যাওয়ার সাধ্য কারও ছিল না।
এ সময় শয়তান এসে বলে দিল যে, ইবরাহীমকে
‘মিনজানিক’ নামক এক প্রকার নিক্ষেপণ যন্ত্রে
রেখে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হোক।
অতঃপর যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) মিনজানিকের মাধ্যমে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিলেন, তখন ফেরেশ্তাকুল বরং দ্যুলোক ও ভূলোকের সমস্ত
সৃষ্টজীব চিৎকার করে উঠল, ইয়া রব! আপনার খলীলের এ কি বিপদ! আল্লাহ্ তাদের সকলকে হযরত
ইবরাহীম (আ.)-কে সাহায্য করার অনুমতি দিলেন।
ফেরেশ্তাগণ সাহায্য করার জন্যে হযরত ইবরাহীম
(আ.)-কে জিজ্ঞাসা
করলে তিনি জওয়াব দিলেন: আল্লাহ্ তা’আলাই আমার জন্যে যথেষ্ট।
তিনি আমার অবস্থা দেখছেন। হযরত জিবরাঈল
(আ.) এসে বললেন: কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমি উপস্থিত আছি। উত্তর হল: প্রয়োজন তো
আছে; কিন্তু আপনার কাছে নয়-পালনকর্তার কাছে।
(তাফসীরে মাযহারী) আল্লাহ্ পাক এরশাদ
করেন :
قُلۡنَا يَٰنَارُ كُونِي بَرۡدٗا وَسَلَٰمًا عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ (سُورَةُ الأَنبيَاءِ : ٦٩)
“আমি বললাম, হে অগ্নি! তুমি ইবরাহীমের জন্যে শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।” (সূরা আম্বিয়া: ৬৯) অর্থাৎ, পুড়ে যাওয়ার মত উত্তপ্ত হয়ো না এবং কষ্টদায়ক পর্যায়ে বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ো না।
বরং মৃদুমন্দ বাতাসের মত হয়ে যাও। সেমতে
তাই হল। বাহ্যত অগ্নি সত্তাগত দিক দিয়ে অগ্নিই ছিল এবং হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আশপাশ ছাড়া অন্য সব কিছুকে
দাহন করছিল।
আর হযরত ইবরাহীম (আ.)- কে যে সব রশি দ্বারা বেঁধে অগ্নিতে
নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সেগুলোও পুড়ে ছাই-ভস্ম হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর দেহে সামান্য আঁচর ও লাগেনি।
ঐতিহাসিক রেওয়ায়াতে আছে— হযরত ইবরাহীম (আ.) এই অগ্নিকুণ্ডে
সাত দিন ছিলেন। তিনি বলতেন: এই সাত দিন আমি যে সুখ ভোগ করেছি, সারা জীবন তা ভোগ করিনি।
(তাফসীরে মাযহারী)
আরো পড়ুনঃ
হযরত ইউসুফ (আঃ) এর ঘটনা - ১ম পর্ব