আম্বিয়ায়ে কেরাম (আঃ) | ৩য় পর্ব | হযরত লূত (আঃ) এর ঘটনা | Baseer

আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস্ সালাম - ৩য় পর্ব

 আহমদ বদরুদ্দীন খান

(সম্পাদক : মাসিক মদীনা)

Table of Contents

হযরত লূত (আ.)এর কওমের উপর আজাব

হযরত লূত আ

হযরত লূত (আ.) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)এর ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি সাদূম নামক জনপদের অধিবাসীদের প্রতি পয়গাম্বররূপে প্রেরিত হয়েছিলেন। এই জনপদের অধীনে আরও সাতটি জনপদ ছিল।

এ সকল জনপদের অধিবাসীরা অনেক নোংরা কাজকর্মে লিপ্ত ছিল। মদ্যপান, গানবাজনা, শ্মশ্রম্নমুণ্ডন, গোঁফ লম্বা করা, কবুতাওবাজি, ঢিলা নিক্ষেপ, শিস বাজানো ইত্যাদি ছিল তাদের নিত্যকার বদঅভ্যাস।

আর লাওয়াতাত ছিল তাদের সর্ববৃহৎ নোংরা কাজ, যা থেকে বন্য জন্তুরাও বেঁচে থাকে। লাওয়াতাত অর্থ সমকামিতা তথা পুরুষের সাথে পুরুষের কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করা।

হযরত লূত (আ.) তাঁর সম্প্রদায়কে এই অভূতপূর্ব কুকর্ম থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে দীর্ঘকাল পর্যন্ত চেষ্টা করেন; কিন্তু তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অবশেষে আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর সম্প্রদায়কে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এতদুদ্দেশ্যে কয়েকজন ফেরেশ্তাকে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্যে হযরত জিবরাঈল (আ.)ও ছিলেন।

Hazrat Lut as wife stone

ফেরেশতাগণের মানবাকৃতিতে আগমনঃ

সাদূম গমনের পথে ফেরেশ্তাগণ মানবাকৃতিতে হযরত ইবরাহীম (আ.)এর গৃহে মেহমান হন এবং তাঁকে বৃদ্ধ বয়সে ইসহাক নামে একজন পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেন।

হযরত ইবরাহীম (আ.) প্রথমে তাদেরকে চিনতে না পারলেও পরে পরিচয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করেন : আপনাদের আগমনের আসল লক্ষ্যউদ্দেশ্য কি? ফেরেশ্তাগণ বললেন: আমরা লূতের কওমের প্রতি প্রেরিত হয়েছি কুফরীর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে নির্মূল করে দিতে।

এ কথা শুনে হযরত ইবরাহীম (আ.) বললেন: সেখানে তো স্বয়ং হযরত লূতও রয়েছেন। কাজেই সেখানে যেন আযাব নাযিল না হয়।

জওয়াবে আল্লাহ্‌ তাআলা ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন : হে ইবরাহীম! লূতের সম্প্রদায় কখনও ঈমান আনবে না।

অতএব তাদের সম্পর্কে আমার চূড়ান্ত নির্দেশ ঘোষিত হয়েছে। এখন তাদের আযাব অপ্রতিরোধ্য। তবে লূতের জন্যে চিন্তার কোন কারণ নেই।

তাকে এবং অপরাপর ঈমানদারগণকে প্রথমে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

এরপর ফেরেশ্তাগণ হযরত ইবরাহীম (আ.)এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হযরত লূত (আ.)আর কাছে উপস্থিত হলেন। তারা সেখানে অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার সুদর্শন তরুণ বেশে আগমন করলেন।

হযরত লূত (আ.) তাদেরকে সত্যিকার মানুষ মনে করলেন। সাথে সাথে তাঁর কওমের বিকৃত যৌন লিপ্সার বিভীষিকা তাঁর মানসপটে ভেসে উঠল। ফলে তাঁর মন ছোট হয়ে গেল এবং তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন।

এহেন সংকটে পড়ে তিনি স্বগতোক্তি করলেন: আজকের দিনটি বড় কঠিন দিন।

সুদর্শন তরুণ মেহমানদের আগমনের সংবাদ পেয়ে হযরত লূত (আ.)এর কওমের লোকেরা পৈশাচিক উন্মাদনায় আত্মহারা হয়ে তাঁর গৃহপানে ধাবিত হল।

হযরত লূত (আ.) অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন এবং অনুনয়বিনয় করে সম্প্রদায়ের লোকদের বললেন: হে আমার কওম! তোমাদের ঘরে আমার কন্যাতুল্য বধূরা রয়েছে। 

তোমাদের যৌনক্রিয়ার জন্যে তারাই তো যোগ্য ও পবিত্র। অতএব নওজোয়ান কিশোরদের প্রতি দৃষ্টিপাত ও হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারে তোমরা আল্লাহ্‌ তাআলাকে ভয় কর।

তোমরা মেহ্মান্দের ব্যাপারে আমাকে লজ্জিত করো না। কিন্তু তাঁর সকল কাকুতিমিনতি ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখে তিনি বললেন: আশ্চর্যের বিষয়, তোমাদের মধ্যে কি একজনও বিবেকবান ভালো মানুষ নেই, যে আমার কথা বুঝবে এবং অন্যকে বুঝাবে?

কওমে লূতের গল্প
কওমের লোকেরা বলল: আপনি তো জানেনই আপনার কন্যাবধূদের প্রতি আমাদের কোন আকর্ষণ নেই। আর আমরা কি চাই, তাও আপনি জানেন। অতএব মেহমানদের কে আমাদের হাতে সমর্পণ করুন।

একান্ত নিরুপায় ও অসহায় অবস্থায় হযরত লূত (আ.) বলতে লাগলেন: হায়! যদি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে তোমাদেরকে শায়েস্তা করার মত শক্তি আমার থাকত! অথবা আমি কোন সুদৃঢ় আশ্রয় গ্রহণ করতে সক্ষম হতাম!

অর্থাৎ, আমার জ্ঞাতিগোষ্ঠী ও আপনজনেরা আমার কাছে থাকলে তোমরা এহেন আচরণ করতে পারতে না।

হযরত লূত (আ.)এর উদ্বেগউৎকণ্ঠা দেখে ফেরেশ্তাগণ বললেন: হে লূত!

আমরা মানুষ নই। আমরা আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশ্তা। অতএব এই দুষ্ট লোকেরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না।

আমাদের তো দূরের কথা, এরা আপনার নিকট পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। কারণ, আমরা তাদের উপর আযাব নাযিল করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।

সুতরাং আপনি রাতের কোন অংশে আপনার লোকজন নিয়ে এখান থেকে অন্যত্র চলে যান। আর সবাইকে হুশিয়ার করে দিবেন যাওয়ার পথে কেউ যেন পিছনে ফিরে না তাকায়।

কিন্তু আপনার স্ত্রী যেহেতু ঈমানদার না বরং কাফেরদের সহযোগিনী, তাই আযাব তার উপরও পতিত হবে। কিছুটা রাত থাকতে আপনাকে সরে যেতে বলছি।

History of Properht lut

কওমে লূতের উপর আজাবের সময়কাল নির্ধারণঃ

কারণ, আযাবের প্রতিশ্রম্নত সময় ভোরবেলা নির্ধারিত হয়েছে। হযরত লূত (আ.) আপন কওমের প্রতি এত বেশী মনোঃক্ষুণ্ণ ছিলেন যে, তিনি বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ আযাব নাযিল করার বাসনা প্রকাশ করলেন।

ফেরেশ্তাগণ বললেন : ভোর বেলা কি খুবই নিকটে নয়?

সেমতে হযরত লূত (আ.) রাত থাকতেই আপন লোকজন নিয়ে অন্যত্র চলে গেলেন। অতঃপর রাত ভোর হল এবং আযাবের ঘনঘ্যা শুরু হয়ে গেল।

prophet lut alaihissalam

কওমে লুতের উপর আজাব এর ঘটনাঃ

এ সম্পর্কে কোরআন পাকে আল্লাহ্‌ বলেন :

فَلَمَّا جَآءَ أَمۡرُنَا جَعَلۡنَا عَٰلِيَهَا سَافِلَهَا وَأَمۡطَرۡنَا عَلَيۡهَا حِجَارَةٗ مِّن سِجِّيلٖ مَّنضُودٖ، مُّسَوَّمَةً عِندَ رَبِّكَۖ وَمَا هِيَ مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ بِبَعِيدٖ (سُورَةُ هُودٍ : ٨۲—٨۳)

অতঃপর যখন আমার আদেশ এল, তখন আমি নগরগুলোকে উল্টিয়ে দিলাম উপরের অংশকে নীচে করে দিলাম এবং সেগুলোর উপর ক্রমাগত বর্ষণ করলাম কংকর, যা আপনার পালনকর্তার কাছে চিহ্নিত ছিল। আর এই নগরসমূহ (মক্কার যালেম কাফেরদের থেকে) দূরে অবস্থিত নয়। (সূরা হূদ : ৮২৮৩)

চারটি বড় নগরে কওমে লুতের বসতি ছিল। আল্লাহ্ তাআলার নির্দেশ পাওয়া মাত্র হযরত জিবরাঈল (আ.) তার পাখা উক্ত নগর চতুষ্টয়ের ভূমির তলদেশে প্রবিষ্ট করে এমনভাবে শূন্যে উত্তোলন করলেন যে, সবকিছু নিজ নিজ স্থানে স্থির ছিল।

Biref Story of Prohet lut

এমনকি পানিভর্তি পাত্র হতে এক বিন্দু পানিও পড়ল না বা গড়াল না। শূন্য থেকে কুকুর, জানোয়ার ও মানুষের স্বাভাবিক চিৎকার ও হৈচৈ ভেসে আসছিল।

এরপর হযরত জিবরাঈল (আ.) জনপদগুলোকে উল্টিয়ে ভূমিতে নিক্ষেপ করে দিলেন। এরপর অবিশ্রান্তভাবে প্রস্তর বর্ষণ করা হল। ফলে সব ধ্বংস হয়ে গেল।

রাসূলে করীম (সা.) এরশাদ করেন : আমার উম্মতের কিছু লোক কওমে লূতের অপকর্মে লিপ্ত হবে। যখন এরূপ হতে দেখবে, তখন তাদের উপরও অনুরূপ আযাব আসার অপেক্ষা করবে।

আরো পড়ুনঃ

হযরত নূহ (আঃ) এর কাহিনী

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনী - ১ম পর্ব

Baseer

Baseer হচ্ছে একটি কুরআন ও হাদিস ভিতিক সহিহ ইসলামিক পোর্টাল। যেখানে এক ঝাঁক আলেম কাজ করছেন ইসলাম সম্পর্কে মানুষ কে সঠিক তথ্য ও উপাত্ত দেয়ার উদ্দেশ্যে। আমাদের পধান লখ্য উদ্দেশ্য হলো, কুরআন ও সুন্নাহ কে নিয়ে সঠক ভাবে রিসার্চ করে দ্বীনের খেদমত করা।

Previous Post Next Post